অনলাইন ডেস্কঃ গাইবান্ধার উপনির্বাচন বন্ধের সিদ্ধান্তে চাপের মুখে পড়েছিল কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়ায় বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় কমিশনর। এই চাপ উতরাতে কমিশনের সাবেক সদস্য ও কর্মকর্তাদের ডেকে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার চেষ্টা করেছে ইসি।
আরও পড়ুনঃ ৩ নভেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর কোচিং সেন্টার বন্ধ
গতকাল বুধবার ইসির সাবেক কর্ণধারদের সঙ্গে মতবিনিময়ে ভোট বন্ধের এই সিদ্ধান্তকে সবাই একযোগে সমর্থন জানিয়েছেন। বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালও সাংবাদিকদের কাছে নিজের স্বস্তির বিষয়টি প্রকাশ করে বলেছেন, ‘গাইবান্ধায় ইসির অ্যাকশনটা সঠিক হয়েছে বলে সবাই সমর্থন জানিয়েছেন। তাঁরা গুরুজন হিসেবে আমাদের সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছেন।’
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত এই মতবিনিময় সভায় ২৮ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নেন ১৪ জন। তাঁদের মধ্যে বিতর্কিত মাগুরা উপনির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালনকারী সিইসি আবদুর রউফ, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের সময় দায়িত্বে থাকা সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী সিইসি কে এম নূরুল হুদাও উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া বৈঠকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, মো. শাহনেওয়াজ, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, ইসি কার্যালয়ের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম, হেলালুদ্দীন আহমদ, এমএম রেজা এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ও মোখলেছুর রহমান অংশ নেন।
ইসি কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিন পর ইসির কোনো সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন দল প্রকাশ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। নিকট অতীতে এই ধরনের পরিস্থিতি পড়তে হয়নি ইসিকে। তাই নিজেদের অবস্থানকে শক্ত করতেই এই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। এমন অস্থির সময়ে সাবেকদের পাশে পেয়ে সিইসির চোখেমুখে স্বস্তি দেখা গেছে। গাইবান্ধার ভোটে দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনের শক্ত অবস্থানের বার্তা দেওয়ার পরামর্শও দেন সাবেক সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা। সেই সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্থানান্তর না করা ও ইভিএম নিয়ে বিতর্কের মধ্যে আস্থা তৈরির আহ্বানও জানান তাঁরা।
তবে ইভিএম কিনতে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাদ দিয়ে আগামী নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসিটিভি বসানোর পরামর্শ এসেছে এই বৈঠকে। অন্যদিকে ৪০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে সিসিটিভি বসানো এবং তা তদারকি কতটা বাস্তবসম্মত সেই প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।
১২ অক্টোবর সিসি ক্যামেরায় ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়ার পর মাঝপথে ঢাকা থেকে নির্দেশনা পাঠিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন। দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে নজিরবিহীন এ ঘটনায় প্রকাশ্যেই ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। বৈঠকে কমিশন নিজেদের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য না দিলেও নির্বাচন বন্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আমন্ত্রিতদের মতামত চাওয়া হয়।
সাবেক তিন সিইসির সমর্থন :অনিয়মের কারণে গাইবান্ধার ভোট বন্ধের পক্ষে নিজেদের সমর্থন জানিয়ে সাবেক সিইসি আবদুর রউফ বলেন, যখন ভোটাররা ভোট দিতে পারেন না, একজনের ভোট আরেকজন দেন, তখন নির্বাচন কমিশন বসে থাকবে কেন? স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের এই অধিকার আছে। তাদের চোখের সামনে ধরা পড়ছে, কারচুপি হচ্ছে। প্রয়োজনে বারবার বন্ধ করতে হবে।
বিতর্কিত মাগুরা উপনির্বাচনে এমন সিদ্ধান্ত আপনি কেন নিতে পারেননি-এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুর রউফ বলেন, ‘আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই। পেছনেরটা টেনে এনে জাতিকে আর অন্ধকারের মধ্যে ফেলবেন না।’ তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার রাজনীতিবিদদের সহযোগী। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারদের হাতজোড় করলেও তাঁরা সরকারের কথাই শুনবেন, ইসির কথা নয়।’
সাবেক সিইসি কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ ইসিকে সংবিধান ও আইন অনুযায়ী কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জনগণকে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। মানুষকে জানাতে হবে। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- নতুন ইভিএম খুবই উন্নতমানের, অলমোস্ট ডিজিটাল।’
সাবেক সিইসি নূরুল হুদা গাইবান্ধার ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ইসির এই ক্ষমতা রয়েছে। তারা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সিসিটিভিতে যাওয়ার পরামর্শ :আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য ৮ হাজার কোটি টাকার ইভিএম প্রকল্প ছেড়ে সব কেন্দ্রে সিসিটিভি বসানোর পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশন ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তাঁর মতে, ভালো হোক মন্দ হোক ইভিএম নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। ১৫০ আসনের ইভিএমে যে বাজেট প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক ভালো সিসিটিভি।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের পুরো নিয়ন্ত্রণ ইসির হাতে নিতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচনে একটি জেলায় একাধিক রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের পরামর্শও দেন তিনি।
ব্যালটে ভোটের পক্ষে মত দিয়ে সাবেক এই কমিশনার বলেন, পেপার ব্যালটে ভোট চুরি হলেও খুঁজে বের করা সহজ। কেন্দ্রের চলমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, বাইরের পরিবেশ অত্যন্ত চমৎকার। ঝামেলা নেই। হইচই নেই। কিন্তু ভেতরে কী হচ্ছে? ব্যালটে এটা করতে হলে বাইরেও হইচই হবে। কারণ সেটি একা করতে পারবে না। জাল ভোট দিতেও ৫-৬ জন লাগবে। এতে করে প্রতিপক্ষ তো হইচই করবে। গাইবান্ধার ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, কমিশন তার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। এখন দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মাঠ প্রশাসনকে আস্থায় আনার পরামর্শ দিয়ে এম সাখাওয়াত বলেন, ভোট কর্মকর্তাদের কনফিডেন্সে আনতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে কমিশন তাঁদের প্রটেকশন দিচ্ছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, এনআইডি ইসির হাত থেকে চলে গেলে ভোট গ্রহণে সমস্যা হবে। ইসির মতবিনিময় সভায় জেলা প্রশাসকদের আচরণ কাম্য নয়।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মনোয়নপত্র জমা দিতে বাধার কারণে অনেক জায়গায় বিনা ভোটে প্রার্থী জয়ী হয়ে যান। প্রচার-প্রচারণায় কখনোই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না, এখনও নেই।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, ইভিএমে ভোট নিতে হলে এনআইডি ইসির হাতে থাকতে হবে। কমিশনের নিজস্ব জনবল রয়েছে, তাঁদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার পক্ষে মত দেন এই সাবেক কমিশনার।
কর্মকর্তারা যা বললেন :বৈঠক সূত্র জানায়, মতবিনিময়ে অংশ নিয়ে ইসি কার্যালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক বলেন, এনআইডি কমিশনের অধীনে রাখতে কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। গাইবান্ধার নির্বাচন বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা নিয়েও সমালোচনা আছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে প্রিসাইডিং অফিসার হন। তাঁদের আস্থায় নিতে না পারলে নির্বাচন পরিচালনা কঠিন হবে।
সাবেক সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশন কী চায় সেটা ভোটার, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের কাছে স্পষ্ট করা প্রয়োজন। শুধু নির্বাচনের দিন নিয়ে কাজ করলে ভোট সুষ্ঠু হবে না। নির্বাচনের পূর্ব সময় নিয়েও কাজ করতে হবে। সব ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন বাস্তবসম্মত নয়।
সাবেক সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, নির্বাচন কর্মকর্তার কোনো অনিয়মকে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা একদম নেই। নির্বাচন কর্মকর্তাকে ক্ষমতায়ন করলে বাইরে থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রয়োজন নেই।
সাবেক সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে জেলা প্রশাসক ছাড়া অন্য কাউকে দিলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
সাবেক সচিব এম এম রেজা বলেন, রাজনীতিতে মেরূকরণ ঘটছে। বরিশালে জেলা পরিষদ নির্বাচনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে একজন জনপ্রতিনিধির আচরণের বিষয়ে ইসিকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের ইসির আস্থায় আনতে হবে। পুরোনো মামলায় প্রার্থীদের হয়রানির বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান বলেন, সংসদ নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সিসিটিভি বসানো অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আগামী নির্বাচনে সব কেন্দ্রে সেনাবাহিনী মোতায়েন অত্যন্ত জরুরি।
স্বস্তিতে সিইসি :তিন ঘণ্টার বৈঠক শেষে স্বস্তি প্রকাশ করে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁদের ডেকেছিলাম-এটা সত্য। গাইবান্ধাতে যে একটা ঘটনা ঘটে গেল আমাদের প্রয়োজন ছিল আরও এনলাইটেড হওয়া; তাঁদের তরফ থেকে কোনো গাইডেন্স আছে কিনা, কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন অতটুকু জেনেছি।’ সিইসির মতে, এটা ক্রিটিক্যাল ছিল। প্রথমবারের মতো বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ ইসি নিয়েছে এবং যথেষ্ট সেনসেশন ক্রিয়েট করেছে সব মহলে। এটি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য হয়েছে।
ভোট বন্ধের পরে মূল্যায়ন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘মূল্যায়নের খুবই প্রয়োজন রয়েছে। যে কোনো বিষয়ে বিচারক হিসেবে আমরা সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করি, বিষয়টা ঠিক হয়েছে কিনা। আমরা শুদ্ধ সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিনা। আমরা সঠিক মনে করছি। তারপরও এটি সঠিক নাও হতে পারে। কোর্টে গিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করেন; তাঁরা যদি বলতেন সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি; তখন আমাদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনার প্রয়োজন হতো। তিনি বলেন, সবাই একমত পোষণ করেছেন। ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে। সাবেকদের বক্তব্যে নিজেরা উৎসাহিত হয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন সিইসি।
গাইবান্ধার নির্বাচনে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে-সাবেক এক কমিশনের এমন মন্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিইসি বলেন, অপেক্ষা করেন, কমিটি কাজ করছে।